ভাতের হোটেলে রবীন্দ্রনাথ কখনো খেতে আসেননি

‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামের কেউ নেই। কখনো ছিলেনও না।’—ব্যাপারটা মানতে পারল না অনেকেই।


ঘটনার শুরু অবশ্য বেশ আগে, ২০৮৫ সালের এপ্রিল মাসে। সে সময় বাজারে এসেছিল এক নতুন অ্যাপ। নাম রবীন্দ্র-জিপিটি। শোনা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর এই চ্যাটবট অবিকল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো লিখতে পারত। ‘হ্যালো’ বললেই ওপাশ থেকে উত্তর আসত, ‘আজি হইতে শতবর্ষ পরে, কে তুমি বসিয়াছ আমার মুখোমুখি। কৌতূহলভরে।’


রবীন্দ্রনাথের সব লেখাকে ‘ডেটা’ হিসেবে কাজে লাগিয়ে অ্যাপটি তৈরি করেছিলেন এক তরুণ প্রোগ্রামার। জনপ্রিয়তাও পেয়ে গিয়েছিলেন দ্রুত। গান-কবিতা-গল্প, প্রেমপত্র তো বটেই; স্কুলের হোমওয়ার্ক, বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র, কিংবা সরকারি অফিসের প্রজ্ঞাপনও বাঙালিরা এই ‘কৃত্রিম রবীন্দ্রনাথ’কে দিয়ে লিখিয়ে নিতে শুরু করেছিল।


 


বছর দু-একের মধ্যেই অ্যাপটি নিষিদ্ধ করা হয়। তবে তত দিনে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। অনলাইন ছেয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য কবিতা, গল্প, গানে। কোনটা আসল, কোনটা নকল, বোঝা কঠিন।


 ২.


এরপর প্রায় ২১৭ বছর পেরিয়েছে। একপ্রকার অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে গত বছর আবারও নতুন করে তাঁকে নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এক তরুণ। নাম স্যাম রবিন।


এক ইন্টারভিউতে স্যামকে বলতে শোনা যায়, ‘ভাবতে পারেন? সে সময় কলম বলতে একটা বস্তু ছিল। মানুষ হাত দিয়ে কাগজে লিখত। আনবিলিভেবল! রাইট বট তো দূরের কথা, কম্পিউটারও ছিল না। সেই সময় একটা লোক একা এত হাজার হাজার গল্প-কবিতা-গান লিখেছে, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? তখন তো থটবটও ছিল না। হেন কোনো বিষয় নেই, যেটা নিয়ে সে লেখেনি। এটা অসম্ভব! রবীন্দ্রনাথ একটা মিথ।’


স্যামের হাইপোথিসিস হলো, ২০-২৫ জনের একটা দল ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামে লিখত। কালের বিবর্তনে সত্যটা হারিয়ে গেছে। অনেকগুলো প্রমাণও হাজির করেছেন তিনি। সেসব কথা থাক।


সম্প্রতি সিদ্ধান্ত হয়েছে, এই বিতর্কের অবসানের জন্য টাইম ট্রাভেলের আশ্রয় নেওয়া হবে। সরাসরি রবীন্দ্রনাথের সময়ে ল্যান্ড করাটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। সে ক্ষেত্রে সময়রেখায় বড় ধরনের ওলট–পালট হয়ে যেতে পারে। পৃথিবীর ইতিহাস পড়ে যেতে পারে মারাত্মক হুমকির মুখে।


তাই ২০২০ থেকে ২০৩০–এর মাঝামাঝি কোনো একটা সময় ঘুরে আসার অনুমতি দিয়েছে বিজ্ঞান অধিদপ্তর। ঠিক হয়েছে, অনুসন্ধানের কাজে পাঠানো হবে একজন হিউম্যানয়েড, অর্থাৎ মানুষের মতো দেখতে রোবটকে। নাম ডিটু নাইনটি ফাইভ।


৩.


সাল ২০২৪। জুলাই মাস।


ডিটু দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা শহরের একটা চার রাস্তার মোড়ে। আর্কাইভে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ সময় জায়গাটা তুমুল কোলাহলপূর্ণ হওয়ার কথা। কিন্তু কেন যেন রাস্তাঘাট সবই অস্বাভাবিক ফাঁকা।


কাজটা খুব কঠিন কিছু নয়। ইন্টারনেট থেকে রবীন্দ্রনাথসম্পর্কিত সব ডেটা ডাউনলোড করতে হবে। কয়েকটা লাইব্রেরি ঘুরে সংগ্রহ করতে হবে আরও কিছু তথ্য। ব্যস। কিন্তু মুশকিল হলো, অনেক চেষ্টার পরও স্থানীয় নেটওয়ার্কের সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত হতে পারল না ডিটু। আশ্চর্য, এমন তো হওয়ার কথা নয়।


অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর এক পথচারীর দেখা পাওয়া গেল। ডিটু জানতে চাইল, ‘এক্সকিউজ মি, এখানে ইন্টারনেট সংযোগ কীভাবে পাব, বলতে পারেন?’


ডিটুকে আপাদমস্তক দেখল লোকটা। বলল, ‘খবর কিছু রাখেন না নাকি? জানেন না, ইন্টারনেট বন্ধ?’


ডিটু একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। অন্য সময় হলে সে আর্কাইভের ডেটা অ্যানালাইসিস করে একটা জুতসই উত্তর দিতে পারত। কিন্তু ক্লাউডের সঙ্গে কানেক্ট করতে না পারায় বেচারা একটু অসহায় হয়ে পড়ল। বলল, ‘আচ্ছা শুনুন, আমি এসেছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে। কোথায় গেলে পাব, বলুন তো?’


লোকটা মনে হলো খুব মজা পেল। কী যেন কী ভেবে মুচকি হেসে বলল, ‘এক কাজ করেন। সামনে গিয়ে ডানে যান। ওখানে কাউরে পাইলে জিজ্ঞাসা করবেন, ভাতের হোটেলটা কোন দিকে? তারা দেখায় দেবে। ভাতের হোটেলে গেলেই সব পেয়ে যাবেন।’


 ‘অনেক ধন্যবাদ।’


এগোল ডিটু। ডানে মোড় নিয়ে খুব বেশি দূর যেতে হলো না। তার পথ আগলে দাঁড়াল সাদা পোশাকের দুজন লোক।


 ‘এই যে, হ্যালো। হনহন করে হাঁটতেসেন। কই যান?’


 


 ‘এখানে একটা ভাতের হোটেল আছে। কোন দিকে, বলতে পারেন?’


প্রশ্ন শুনেই কেন যেন খেপে গেল তারা, ‘মশকরা করেন? ফাজলামি? দেখি, মোবাইল বাইর করেন।’


 ‘মাফ করবেন। আমার কাছে তো কোনো মোবাইল নাই।’ একটু ঘাবড়ে গেল ডিটু। লোক দুটো কেমন যেন মারমুখী। বেচারা গবেষক রোবট। এ রকম পরিস্থিতিতে সে অভ্যস্ত নয়।


 ‘মোবাইল নাই মানে?’ কোমরের কাছে প্যান্ট আঁকড়ে ধরল একজন। ‘চল, দেখাচ্ছি তোকে ভাতের হোটেল। এমন সাইজ করব, নিজের নাম ভুলে যাবি।’


৪.


কয়েক দিন পর। দেখা গেল রাস্তার পাশে হতভম্ব হয়ে বসে আছে ডিটু। কেমন যেন উদ্ভ্রান্ত। শরীরের নানা জায়গায় আঘাতের দাগ।


দেখে মায়াই হলো এক পথচারীর। কাছে এসে সে বলল, ‘ভাই কি হারায়ে গেছেন? কোনো সমস্যা?’


উত্তর নেই।


 ‘নাম কী আপনার?’


চোখ পিটপিট করল ডিটু। মাথাটা অদ্ভুতভাবে নড়ে উঠল। মনে হলো অনেক কষ্টেও সে নিজের নাম মনে করতে পারছে না।


 ‘আরে ভাই, নিজের পরিচয় জানেন না? কে আপনি?’


পথচারী আবার জানতে চায়।


কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ। ডিটুর মাথার ভেতর থেকে ঘ্যাচ ঘ্যাচ ঘ্যাচ ঘ্যাচ শব্দ হয়। অনেকটা ক্যাসেটের ফিতা পেঁচিয়ে যাওয়ার মতো। অতঃপর সে উত্তর দেয়, ‘আমি…আমি রবীন্দ্রনাথ।’